প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে শিক্ষকরা যেমন বেতন পাচ্ছেন - bdmorning24news

প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে শিক্ষকরা যেমন বেতন পাচ্ছেন

সরকারি তথ্য ও বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ বলছে, বেতন কাঠামো ও মর্যাদার দিক থেকে বাংলাদেশের শিক্ষকরা বর্তমানে এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থানে রয়েছেন। মাত্র অষ্টম শ্রেণি পাস একজন সরকারি গাড়িচালকের গ্রেড ১২তম হলেও স্নাতক ও মাস্টার্স ডিগ্রিধারী সহকারী প্রাথমিক শিক্ষকদের গ্রেড ১৩তম। এতে তাদের মূল বেতন মাত্র ১১ হাজার টাকা। বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা মিলিয়ে মাসিক মোট আয় দাঁড়ায় প্রায় ১৯ হাজার ৫০০ টাকা— যা বর্তমান বাজারদরে টিকে থাকার জন্য একেবারেই অপর্যাপ্ত।

মাধ্যমিক স্তরের সহকারী শিক্ষকদের অবস্থাও প্রায় একই। তাদের গড় বেতন প্রায় ১২৩ ডলার, যা দেশের মাথাপিছু গড় মাসিক আয়ের চেয়ে প্রায় ১১২ ডলার কম। ক্রমবর্ধমান নিত্যপণ্যের বাজারে এই বেতনে পরিবার চালানো ‘পাহাড়সম কঠিন’ হয়ে পড়েছে বলে অভিযোগ করেছেন শিক্ষকরা।

বর্তমান বেতন কাঠামো

২০১৫ সালের জাতীয় বেতন স্কেল অনুযায়ী প্রাথমিক পর্যায়ের জুনিয়র শিক্ষকরা ১৬তম গ্রেডে ৯,৩০০ টাকা মূল বেতন পান। সব ভাতা যোগে মোট বেতন হয় প্রায় ১১,৮০০ টাকা (৯৭ ডলার)। বাংলা, ইংরেজি, গণিত ও বিজ্ঞান বিষয়ক সহকারী শিক্ষকদের বেতন ১১তম গ্রেডে ১২,৫০০ টাকা থেকে শুরু হয়ে ভাতা যোগে দাঁড়ায় প্রায় ১৫ হাজার টাকা (১২৩ ডলার)। বিএড ডিগ্রিধারীরা ১০ম গ্রেডে যোগ দিয়ে মোট বেতন পান প্রায় ১৮,৫০০ টাকা (১৫২ ডলার)।

প্রতি বছর ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট, দুইটি উৎসব ভাতা (প্রতি ভাতা মূল বেতনের ২৫ শতাংশ) ও একটি বৈশাখী ভাতা (২০ শতাংশ) থাকলেও জীবনযাত্রার ব্যয়ের সঙ্গে এই আয় সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের।

প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় পিছিয়ে বাংলাদেশ

ভারত, নেপাল, পাকিস্তান ও ভুটানে শিক্ষক পেশাকে মধ্যবিত্ত মর্যাদার পেশা হিসেবে দেখা হয়। সেখানে শিক্ষকরা বাংলাদেশের তুলনায় অন্তত তিনগুণ বেশি বেতন পান। ইন্দোনেশিয়া ও চীন শিক্ষক সার্টিফিকেশন ও আবাসন সুবিধা দিয়ে প্রকৃত আয় বাড়িয়ে থাকে। দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানে শিক্ষকতা উচ্চ মর্যাদা ও উচ্চ বেতনের পেশা, যা শিক্ষার মানেও প্রতিফলিত হয়।

ওইসিডি দেশগুলোতে শিক্ষক বেতনকে মানবসম্পদে বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য করা হয়। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জার্মানিতে শিক্ষকরা মধ্যবিত্ত জীবনযাপন করতে পারেন এমন বেতন ও সুবিধা পান, যা তাদের শিক্ষাদানে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।

নতুন বেতন স্কেলের প্রস্তাব

২০২৫ সালের ২৪ জুলাই গঠিত জাতীয় বেতন কমিশন ২০২৬ সালের জানুয়ারি থেকে নবম জাতীয় বেতন স্কেল বাস্তবায়নের সুপারিশ চূড়ান্ত করছে। এতে প্রাথমিকভাবে শিক্ষকদের বেতন ৯০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব রয়েছে। ফলে সহকারী শিক্ষকদের বেতন ১৮ হাজার থেকে বেড়ে ২০ হাজার টাকা (১৪৮–১৬৪ ডলার) হতে পারে। তবে মুদ্রাস্ফীতি বিবেচনায় প্রকৃত সুফল কতটা মিলবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক শাহ শামীম আহমেদ বলেন, “শিক্ষকদের অন্য পেশার সঙ্গে তুলনা করা যায় না। তারা জাতি গঠনের কারিগর। অথচ অধিকাংশ শিক্ষক মাসে ১৫–১৬ হাজার টাকার বেতনে পরিবার চালাতে হিমশিম খান। এতে তারা কোচিং বা টিউশনি করতে বাধ্য হন, যা শিক্ষার মানে প্রভাব ফেলে।”

তার মতে, “সম্মানজনক ও জীবনধারণযোগ্য বেতন নিশ্চিত করা গেলে শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আসবে। বর্তমান বাস্তবতায় শিক্ষকদের বেতন অন্তত দুই থেকে তিনগুণ বাড়ানো জরুরি।”

বৈষম্যের শঙ্কা

বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, শিক্ষক মর্যাদা ও বেতন কাঠামোতে সংস্কার না এলে দেশে দুই শ্রেণির শিক্ষা ব্যবস্থা পাকাপোক্ত হবে—যেখানে ধনী পরিবারের শিশুরা ভালো শিক্ষা পাবে, আর দরিদ্র পরিবারের শিশুরা থেকে যাবে নিম্নমানের শিক্ষায়।

তাদের মতে, “আজকের শ্রেণিকক্ষই আগামী দিনের সংসদ ও রাষ্ট্রের ভিত্তি। শিক্ষককে যদি ক্লার্কের মতো বেতন দেওয়া হয়, তাহলে জাতিও ক্লার্কের মতো চিন্তা করবে।”

বাংলাদেশে শিক্ষাখাতে ব্যয় জিডিপির মাত্র ১.৫৩ শতাংশ—যা এসডিজি লক্ষ্যের অর্ধেক। ফলে শিক্ষক সংকট, মানহীন শিক্ষা ও সমতা ঘাটতির এই চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে হলে শিক্ষকদের মর্যাদা ও বেতন কাঠামো পুনর্বিবেচনা এখন সময়ের দাবি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *